ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি যত এগিয়ে আসছে,এই ভারতবর্ষ কি করতে পেরেছে , আর কি করতে পারেনি , তা নিয়ে তত বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। যদিও বা তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই বর্তমান পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন নিয়ে একটি নোংরা রাজনৈতিক খেলাও শুরু হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথকে অতীতের ভারত ভাবিয়েছিল আধুনিক ভারত নির্মাণের প্রয়াসে।ফলে তাঁর ভারতভাবনার মধ্যে সমকালীন রাজনীতি, অর্থনীতি, ভূগোল ও সমৃদ্ধ ভারতের একটি সুস্থ রূপকল্প ঠাঁই পেয়েছিল।
স্বাধীনতার ৭ দশক পরে আজকের ভারতকে যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখতেন তাহলে জনসাধারনের ব্যাপক নিরক্ষতা ও প্রকৃত শিক্ষার অভাব দেখে যতটা আঘাত পেতেন ততটা আর কিছুতে পেতেন কি না সন্দেহ। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় জাতীয়তাবাদী নেতারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এটাকে তিনি তার প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখতেন। ১৯৪৭-র আগস্ট মাসে স্বাধীনতার পূর্বলগ্নে নেহেরুজি তাঁর সেই উদ্ধুদ্ধকারী বক্তৃতাতেও (Tryst with Destiny) সেই অঙ্গীকারের পুনরাবৃত্তি করেছিলেন।
যেহেতু শিশু শিক্ষার উপর রবীন্দ্রনাথের বিশেষ আগ্রহ ছিল, তাই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার বিস্তার দেখে তিনি কোন সান্ত্বনা পেতেন না— তা ভারত যতই চীনের তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছয়গুণ বেশি সংখ্যায় ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠান না কেন। বরং স্তম্ভিত হতেন চীনসহ পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে পার্থক্য দেখে, কেননা ভারতে আজ শিশু শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে শিশু ধর্ষণের সংখ্যাটি দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। প্রকৃত শিক্ষা থেকে শিশুরা বঞ্চিত হওয়ার কারণেই যুবসমাজ দেশপ্রেম , সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা , থেকে দিনের পর দিন দূরে সরে যাচ্ছে।
১৯৮০ সালের শেষ দিকে যদিও বা গ্রাম অঞ্চলের ১২ থেকে ১৪ বছর বয়স্ক মেয়েদের মধ্যে অর্ধেকই জীবনে একটি দিনও স্কুলে যায়নি।
এই অবস্থার উদ্ভব হয়েছিল জনশিক্ষার প্রতি ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী অবহেলার ফলে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতের চিরাচরিত ভদ্রলোকতন্ত্র এবং সমসাময়িক রাজনীতিতে উচ্চশ্রেণীর আধিপত্য ( এর ব্যতিক্রম কেরালা প্রভৃতি ভারতের কোনও কোনও অংশ , যেখানে উচ্চবর্ণ বিরোধী আন্দোলনের জোর পড়েছে শিক্ষার উপর, যা উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ দূর করার কাজে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে)। রবীন্দ্রনাথ দেখতেন নিরক্ষতা এবং শিক্ষায় অবহেলা শুধু যে ভারতের অপরিবর্তিত সামাজিক দুরবস্থার জন্য দায়ী তাই নয় , এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা ও প্রসারকেও খর্ব করে রেখেছে। তিনি এটাও খুব প্রবল ভাবে উপলব্ধি করতেন যে , ভারতের দুরপনেয় দারিদ্র দূর করার জন্য অধিকতর দায়বদ্ধতা এবং অবিলম্বে উদ্যোগ গ্রহণ করার বোধ-এর প্রয়োজন আছে।
আজ সচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার- বিগত কয়েক বছর ধরে যেভাবে ভারতবর্ষের মাটিতে গণতন্ত্রের হত্যা হচ্ছে এবং এখানকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থেকে যে ভাবে দিনের পর দিন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে চলেছে। সে সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা উত্তর ভারতের রাজনীতি হঠাৎ করে খুব দ্রুততার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা কে যেভাবে এক আবদ্ধ শৃংখলে মধ্যে আটকে রেখেছে , সেটা দেখে তিনি সত্যিই খুব দুঃখের সঙ্গে গভীর চিন্তায় ডুবে থাকতেন।
অন্য অনেক দেশের মতোই ভারতেও আজ সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি পাচ্ছে দেখে রবীন্দ্রনাথ মর্মাহত হতেন। যে “মুক্ত আবহাওয়া” কে তিনি অতি মূল্যবান বলে মনে করতেন, এই মুহূর্তে তা বর্তমান ভারতবর্ষে বিপন্ন। ধর্মীয় মৌলবাদের পন্থা অনুসরণ করার লোক স্বাধীনতার পর কয়েকটি দশক অপেক্ষাকৃত কম হলেও কয়েক বছর থেকে হঠাৎ করে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে তিনি আশ্চর্য হতেন। নিঃসন্দেহে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতাবাদ অনেকটা পরিমাণে সাফল্য অর্জন করেছে। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ধর্মীয় মতান্ধতার বিস্তার কৃত্তিম সাংস্কৃতিক বিষন্নতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
হিন্দুত্ব দিয়ে ভারতের সংজ্ঞা নিরুপম করার চেষ্টায় তিনি প্রবল ভাবে প্রতিরোধ করতেন। তিনি চাইতেন ভারতকে দেখা হোক অনেক সংস্কৃতির সঙ্গম হিসেবে। ভারতের সাংস্কৃতিক পটভূমিকার বিমিশ্রতা এবং তার নানা বৈচিত্র্যসমূদ্ধ ইতিহাসের দিকে অঙ্গুলি নিদর্শন করে রবীন্দ্রনাথের সাব্যস্ত করেছেন —‘ভারতের ভাবচিত্র’ই সাংস্কৃতিক বিচ্ছন্নতাবাদী মনোভাবের বিরোধিতা করে —‘বিরোধিতা করে ,আমরা জাতি অন্য সব জাতি থেকে পৃথক’ , এই বোধের তীব্রতার।
পাশ্চাত্য প্রভাব সম্পর্কে অতিরঞ্জিত ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবোধের সাম্প্রতিক প্রসারেরও তিনি বিরোধিতা করতেন। মানুষ গঠনমূলকভাবে বিভিন্ন সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করতে পারে , তাঁর এই বিশ্বাস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কোন রকম আপোষ করতে রাজি ছিলেন না; এ প্রসঙ্গে জোর দিয়ে এ কথাও বলা দরকার যে ভারতের নিজস্ব ঐতিহ্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের গর্ববোধে কোনও ঘাটতি ছিল না। প্রায়ই তিনি এ-প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। ভারতের ধর্মীয় ভাবনা নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দিয়ে তিনি স্পষ্টত খুশিই হয়েছিলেন। তাতে তিনি প্রাচীন শাস্ত্র এবং লোকসাহিত্য (যথা , ষোড়শ শতাব্দীর মুসলিম কবি কবীর) উভয়ের থেকেই উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন ।
যে বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কিছুটা সন্তুষ্ট করতো সেটা হলো ‘পৃথিবীর এ যাবৎ বিভিন্ন প্রভাব একটি কেন্দ্র অভিমুখে মিলিত হয়ে, ভারতীয় সমাজের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে; যথা হিন্দু ,মুসলমান ,খ্রিস্টান ,ধর্মনিরপেক্ষতার , স্টালিনবাদী , উদারনৈতিক , মাওবাদী, গণতান্ত্রিক-সমাজবাদী , গাঁন্ধীবাদী ইত্যাদি। পূর্ব কিংবা পশ্চিমে এমন কোনও চিন্তা-ভাবনা নেই , যা কোনও না কোনও ভারতীয় মনে কখনও ক্রিয়াশীল হয়নি।
তিনি এটা দেখেও খুশি হতেন যে , ১৯৭০-র দশকে ইন্দিরা গান্ধী-র জরুরি অবস্থা ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকার যখন সাধারণভাবে দেশের মৌলিক স্বাধীনতাসমূহ এবং রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারসমূহ অপহরণ করে, তখন ভারতের নির্বাচকমন্ডলী তাঁর সেই কাজকে সম্পূর্ণভাবে খারিজ করে দেন (তিনি মর্মাহত হতেন বর্তমান ভারতবর্ষে নির্বাচন কমিশন দিনের-পর-দিন দল দাসে পরিণত হতে চলেছে দেখে) । ইন্দিরা গান্ধীর সরকারকে ধরাশায়ী হতে হয়েছিল (ইতিহাসের পরিহাস , ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন বিশ্ব ভারতের প্রাক্তন ছাত্রী!) ।
তিনি এও দেখতেন যে সরকারের নীতির যে-পরিবর্তনের ফলে স্বাধীনতার পরে দুর্ভিক্ষ দূর হয়েছে , তা অধিকাংশ কৃতিত্ব দাবি করতে পারে গণতান্ত্রিক ভারতে কথা বলার স্বাধীনতা ( যদিও বা সেই স্বাধীনতা বিগত কয়েক বছর ধরে ক্ষুন্ন হতে শুরু করেছে !) ।
রবীন্দ্রনাথের রাজা ও রানী নাটকে ক্ষুধার্থ প্রজাদের প্রতি রাজকীয় নীতির নির্মমতার বিরুদ্ধে সহৃদয়া রাণী শেষপর্যন্ত বিদ্রোহ করেন। প্রথমেই তিনি জানতে চান প্রসাদের বাইরে কুৎসিত গোলমাল কী নিয়ে।
উত্তরে তিনি শুধু শুনলেন ,
“ কিছু না , কিছু না।
শুধু ক্ষুধা , হীন ক্ষুধা , দরিদ্র্যর ক্ষুধা।
অভদ্র অসভ্য যত বর্বরের দল—
মরিছে চিৎকার করি ক্ষুধার তাড়নে
কর্কশ ভাষায়।”
ভারতে আধুনিক কল-কারখানার উদ্ভবে রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজীর মত আপত্তি করতেন না, আধুনিক প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান উন্নতিতেও ক্রুদ্ধ হতেন না । তার কারণ তিনি চাইতেন না দেশ এক ‘আদ্যিকালে উদ্ভাসিত চাকার সঙ্গে’ চিরটাকাল শিকল দিয়ে বাঁধা পড়ে থাক। মানুষ যাতে যন্ত্রের দাসত্ব না করে , সে ভাবনা তাঁর ছিল , কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির সদ্ব্যবহারে তার আপত্তি ছিল না। পরিবেশ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ ছিল গভীর। অরণ্যবিনাশ ছিল তাঁর বিশেষ উদ্বেগের কারণ এবং তিনি সেই ১৯২৮ সালেই “বৃক্ষ-রোপণ” উৎসবের প্রবর্তন করেন। তিনি চাইতেন পরিবেশ সংরক্ষণের বিচারে সরকারি ও বেসরকারি দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি পাক। কিন্তু তাই বলে আধুনিক শিল্প ও প্রযুক্তির বিরোধিতা করতে হবে এটা তিনি মনে করতেন না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চাইতেই প্রত্যেক বিচার্য বিষয় নিয়ে খোলাখুলি বিতর্ক হোক। যান্ত্রিক সূত্রের ওপর ভিত্তি করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিশ্বাস ছিল না তাঁর— তা সে সিদ্ধান্ত , বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে , যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন (যদিও বা বর্তমান সরকার ছোটখাটো সিদ্ধান্ত তো দূরের কথা , দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও খোলাখুলি আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না। এবং খুব দুর্ভাগ্যের সঙ্গে বলতে হচ্ছে — দেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতিও বেশিরভাগ সিগনেচার গুলি করে থাকেন রাতের অন্ধকারেই)। উদাহরণ হিসেবে , আমাদের ঔপনিবেশিক প্রভুরা ‘এটা আমাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে — তাই এটা আমাদের খারিজ করতে হবে’, ‘এটা হলো আমাদের ঐতিহ্য , অতএব এটা আমাদের মানতেই হবে’, ‘এ বিষয়ে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ , সুতরাং সে অঙ্গীকার আমাদের পালন করতেই হবে’ , ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ বারে বারে যে-প্রশ্নটি করেন , তা হলো যা করার কথা বলা হচ্ছে সেটা আমাদের কাম্য কি না তা সব দিক দিয়ে খতিয়ে দেখা। ইতিহাস খুবই মূল্যবান ঠিকই , কিন্তু যুক্তিবুদ্ধিকে অতীত অতিক্রম করে যেতে হবে। যুক্তিবুদ্ধি — স্বাধীন , নির্ভীক যুক্তিবুদ্ধি — সব কিছুর ঊর্ধ্বে , এই উপলব্ধির মধ্যেই আমরা রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী কণ্ঠস্বর শুনতে পাই।
স্বাভাবিক কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাতীয়তাবাদ , ধর্মনিরপেক্ষতা , শিক্ষাদানের দৃষ্টিভঙ্গি , মানুষের চিন্তা-ভাবনা স্বাধীনতা , সর্বোপরি গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো নিয়ে আলোচনা খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।
দ্রঃ
“The Argumentative Indian”— অমর্ত্য সেন
“ধর্মভাবনা” — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রচিত দুটি গ্রন্থের সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে লেখার ক্ষেত্রে।
Siddique Ali – Murshidabad.
WB State Media Co-ordinator @IYC .