বিষয়- দিলীপ ঘোষের মুসলিম সম্প্রদায় নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য ও তার বিশ্লেষণ!
কলমে- Siddique Ali (State Media Co-ordinator @Youth Congress.
And President – Murshidabad Assembly Youth Congress.
Ex-State Research Co-ordinator @ Youth Congress)
প্রসঙ্গ: দিলীপ ঘোষের মুসলিম সম্প্রদায় নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য ও তার বিশ্লেষণ
আমার অবস্থান: দিলীপ ঘোষের সঙ্গে সহমত।
বিরোধী রাজনৈতিক দল কিংবা অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়া মানেই সর্বদা বিরোধিতা করা নয়।এটাই একজন মানুষ হিসেবে সামাজিক দায়িত্ব বলে আমি মনে করি।
ফেসবুক লাইভে মুসলিম সম্প্রদায়কে নিয়ে বলতে গিয়ে দিলীপ ঘোষ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিষয়গুলি উত্থাপন করার জন্য দিলীপ ঘোষকে ধন্যবাদ জানাই।
এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে ,শুধু দিলীপ ঘোষ নন , বিজেপি এবং আরএসএস সর্বদা একটি ধর্মীয় অ্যাঙ্গেলে কথা বলে থাকেন। স্বাভাবিক কারণেই হয়তো ফেসবুক লাইভে মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কিত কথা বলার জন্যই দিলীপ ঘোষের বক্তব্য টিকে ,বিতর্কিত মূলক বক্তব্য বলে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু আমরা মতে ,যে বিষয়গুলি দিলীপ ঘোষ উত্থাপন করেছেন ,সেই বিষয়গুলি নিয়ে সত্যিই চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন রয়েছে। শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ নয় ,সমগ্র বাঙালি সম্প্রদায়কে উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে হলে – এই বিষয়গুলি সমাধান করার প্রয়াস সরকারের পক্ষ থেকে দেখানোর প্রয়োজন রয়েছে।
দিলীপ ঘোষের উত্থাপিত বিষয় :
ক) শিক্ষায় ,সামাজিকতায় ,চেতনায় সবকিছুতেই মুসলিমরা পিছিয়ে। তাদের মধ্যে অপরাধীকরণ সবথেকে বেশি।
খ) তৃণমূল কংগ্রেস মুসলিমদের তোষণ করতেই ব্যস্ত।
মূলত এই তিনটি ভ্যালিড পয়েন্ট দিলীপ ঘোষ তুলে ধরেছেন।
এবং তার সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটি প্রশ্ন রেখেছেন প্রশ্ন টি হল —
প্রশ্ন : বাংলায় বামফ্রন্ট ও তৃণমূল 44 বছর ধরে মুসলিমদের তোষণ করে চলেছে, তাও তারা এত পিছিয়ে কেন ?
কেন ওদের কোন উন্নতি হলো না?
এই দুটি প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক। মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের দিকে নজর রাখলেই যে কোন মানুষ এই প্রশ্নগুলো উত্থাপন করবেন।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে একটি বিষয় পরিষ্কার, স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের সরকারি চাকরির ভাগিদারী ছিল 10 থেকে 12 শতাংশ। কিন্তু বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রেসের জামানায় মুসলিম সম্প্রদায়ের চাকরির শতাংশ ১ অথবা ১ এর নিচে নিম্নগামী যাত্রা শুরু করেছে। বামফ্রন্ট জামানায় 10 – 12 শতাংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের সরকারি চাকরির ভাগিদারী থেকে ১.৫-২ শতাংশের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছিল। এখান থেকে পরিষ্কার বিগত ৪৪ বছরে কি ভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হলো মুসলিম সম্প্রদায়ের শিক্ষিত যুবক ছেলে মেয়েরা কি বঞ্চিত হয়েছে ?
না তারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদেরকে প্রয়োজনীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে?
উঃ যদি বঞ্চিত হয়ে থাকে ,তাহলে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে যে — তাদেরকে কিভাবে রাজনৈতিক দলগুলি ব্যবহার করছে? আর যদি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ছিল , সেই শিক্ষার থেকে যদি পিছিয়ে পড়ে , তাহলেও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ভাবার প্রয়োজন রয়েছে কেন তারা পিছিয়ে পড়েছে ?
এখানে আমি একটি উদাহরণ দিতে চাই যেখান থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে যে — মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ত্রুটি কোথায় ?
বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে “#আলাআমিন_মিশন” থেকে শুরু করে যে সমস্ত মিশনগুলো তৈরি হয়েছে ,সেই মিশনগুলো যদি তৈরি না হতো , তাহলে আমার মনে হয় পশ্চিমবঙ্গে , যে সমস্ত ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার টিচার রয়েছেন তাদের একটি বড় অংশ সেই জায়গাতে পৌঁছাতে পারতেন না। অর্থাৎ মুসলিম সমাজের উচ্চ শিক্ষায় অথবা ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ক্ষেত্রে বিগত 15 বছর থেকে কুড়ি বছরের মধ্যে মিশনের একটি বড় অবদান রয়েছে। এবং সেক্ষেত্রে মুর্শিদাবাদের পতাকা ইন্ডাস্ট্রির মোস্তাক আহমেদ এর অবদান অনস্বীকার্য।
মুসলিম অধ্যুষিত যে সমস্ত জেলা গুলি রয়েছে, সেই সমস্ত জেলাগুলির দিকে যদি দৃষ্টিপাত করা হয় , তাহলে আমরা দেখতে পাব প্রথমতঃ মুর্শিদাবাদ জেলা। যে জেলায় রাজনৈতিক হত্যা বারংবার হয়ে আসছে। নির্বাচন মানেই রাজনৈতিক হত্যা’ আবশ্যিক হয়ে পড়েছে। তাছাড়া গ্রামের বিভিন্ন প্রান্তে “#মুরগি_মারা” থেকে শুরু করে “#জমির_বিবাদ” সামান্যতম ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেআইনি অস্ত্রের আবির্ভাব আমরা দেখতে পাই। একই চিত্র আমরা দেখি মালদা জেলার ক্ষেত্রেও । পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে এই দুটি জেলা মুসলিম অধ্যুষিত জেলা।
এখন প্রশ্ন হলো কেন এই দুটি জেলায় এই ধরনের চিত্র আমরা দেখতে পাই।
উঃ- তার অন্যতম কারণ হলো মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে যেমন বিদ্যালয়ের অভাব রয়েছে। ঠিক একইভাবে রাস্তাঘাট, স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং কর্মসংস্থানের অভাব প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। স্বাভাবিক কারণে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় শিক্ষার সচেতনতা এখনো সেভাবে পৌঁছায়নি। যে জায়গায় শিক্ষার আলো পৌঁছাতে দেরি হবে , সেই জায়গার সামাজিকতা বা চেতনার দিকটি অন্ধকার থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
আমাদের দ্বারা প্রকাশিত সব খবর, আপনার হোয়াটসঅ্যাপে পেতে ক্লিক করুন।
আজ দিলীপ ঘোষ যে প্রশ্নগুলি করেছেন বা যে বিষয়গুলো উত্থাপন করেছেন , সেই বিষয়গুলো যদি রাজ্য ও কেন্দ্রসরকারের প্রচেষ্টায় সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে না পারে , তাহলে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ পিছিয়ে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক । কেননা আপনারা যদি ভালোভাবে লক্ষ্য করেন , তাহলে দেখতে পাবেন — মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলো বাংলাদেশের বর্ডার সংলগ্ন এলাকায়। বর্ডার দিয়ে বিভিন্ন ধরনের বেআইনি কাজের সঙ্গে অনেক মানুষ যুক্ত । স্বাভাবিক কারণে সেই জায়গাগুলিতে যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন রয়েছে , ঠিক একইভাবে যে সমস্ত মুসলিম এলাকায় বেআইনি অস্ত্রের দাপাদাপি নিত্যদিন দেখা যায় , সেই সমস্ত এলাকায় রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের পদক্ষেপ, এবং তার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা স্বাস্থ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং কর্মসংস্থানের প্রতি যদি সরকার নজর না দেয়, তাহলে মুসলিম সমাজের অবস্থার পরিবর্তন হওয়া কোনমতেই সম্ভবপর নয়।
এখন আপনার প্রশ্ন করতেই পারেন তাহলে কিভাবে 44 বছর আগে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে এগিয়ে ছিলেন ?
উঃ- দেশের স্বাধীনতা লাভ করার পর তৎকালীন সরকারের সুপরিকল্পনা মাফিক নীতি গ্রহণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের জায়গা থেকে শুরু করে যেভাবে সমাজব্যবস্থাকে পশ্চিমবঙ্গের উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন সেই উন্নয়নের চাকা আজ থমকে গেছে। আর পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন থমকে যাওয়ার ফলে বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পরিশেষে শুধু একটি কথাই বলবো মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় রিসোর্সের কোন অসুবিধা নেই। যেমন আমার জেলা মুর্শিদাবাদ , যে জেলার প্রায় ৬৭ শতাংশ মানুষ মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। এই জেলায় 9 থেকে 10 টি নদী রয়েছে, তার অসংখ্য শাখা প্রশাখা রয়েছে। তার পরেও এই জেলায় মৎস্য চাষ ব্যর্থ। এই জেলার পাটশিল্প দিনের-পর-দিন বিলুপ্তির পথে অগ্রসর হচ্ছে। মুর্শিদাবাদ জেলায় হাজার হাজার টন আমের ফলন হলেও মুর্শিদাবাদ জেলায় কোন রকম ফুড প্রসেসিং হাব নেই। মুর্শিদাবাদ জেলা অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পরা জেলা , তবুও এই জেলায় কোন বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ রূপে গড়ে উঠলো না। স্বাভাবিক কারণে মুর্শিদাবাদ জেলার ছেলেমেয়েদেরকে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতা মুখি হতে হয়। মুর্শিদাবাদ জেলায় আজ থেকে কুড়ি বছর আগেও সবজি চাষ হতো । কিন্তু ধীরে ধীরে সবজি চাষ হারিয়ে যাচ্ছে , ফলে মাঠের কাজ ছেড়ে ভিন রাজ্যে অথবা ভিন দেশে পাড়ি দিতে হচ্ছে জেলাবাসীকে।
মুর্শিদাবাদ জেলার তাঁত বস্ত্র শিল্প , কাঁসার আসবাবপত্র থেকে শুরু করে কুটির শিল্প অর্থাৎ হাতের কাজের জন্য বিখ্যাত কিন্তু সে কুটির শিল্প আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে যাত্রা শুরু করেছে।
এত কিছু থাকা সত্ত্বেও মুসলিম সম্প্রদায়ের আধিক্য এই জেলার পরিচয় কি ? আপনার কখনো ভেবে দেখেছেন ?
একদা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদের মা-বোনেদের পরিচয় “#বিড়ি_শ্রমিক” ! বাবা-দাদাদের পরিচয় ‘#লেবার_রাজমিস্ত্রি’ ! মুর্শিদাবাদের কথা উঠতেই ভিন রাজ্যে বা বিভিন্ন জেলায় আমরা শুনতে পাই— মুর্শিদাবাদের রাজমিস্ত্রি ভালো ! মুর্শিদাবাদের বিড়ি ভালো !
এটা কি আনন্দের ? না এটা দুঃখের ?
এর জন্য দায়ী কি আমরা নই ? যাদেরকে আমরা আমাদের প্রতিনিধিরূপে নির্বাচিত করছি , তারা কি সত্যিই এই সমস্ত বিষয়গুলি নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছেন ?
এই বিষয়ে বিবেচনা করার জন্য আপনাদের হাতেই আমি ছাড়লাম।
এখন সময় এসেছে দিলীপ ঘোষের মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কিত মন্তব্যকে “#বিতর্কিত_মন্তব্য” বলে চালিয়ে দেওয়া নয় , সময় এসেছে আমাদের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের আত্মসমালোচনা করার।
আশা রাখবো আমার উপরোক্ত কথাগুলো নিয়ে আপনারা বিবেচনা করবেন।
প্রত্যেকে ভাল থাকুন , সুস্থ থাকুন।