নজর বাংলা ওয়েব ডেস্ক: পঞ্জিকা হলো বাংলা ওড়িয়া, মৈথিলী, অসমীয়া ভাষায় প্রকাশিত হিন্দু জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় পঞ্জিকা। আড়ম্বরপূর্ণ ভাষায় একে ‘পাঁজি’ বলা হয়। এটি ভারতে প্রকাশিত সর্বাধিক জনপ্রিয় বার্ষিক বইগুলির মধ্যে অন্যতম এবং এটি পর্যবেক্ষক হিন্দুদের তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান, উৎসব, উদ্যাপন এবং বিবাহ, ভ্রমণ, ইত্যাদিসহ বিভিন্ন প্রকারের সাধনার জন্য সর্বাধিক শুভ সময় নির্ধারণ করার একটি সহজ রেফারেন্স।
আরও পড়ুন:Horoscope Today: আজ আগে ঋণ দেওয়া কোনও টাকা তৎক্ষণাৎ ফিরে আসবে (১৬/১০/২১)
কোনও কোনও পুরোহিত বা জ্যোতিষীর কাছে বিশদ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এটি কিছুটা প্রস্তুত-গণনাকারী বা প্রথম উৎস। এমনকি হিন্দুদের মধ্যে ‘অবিশ্বাসী’ এবং যারা হিন্দু নন তারা প্রায়শই ব্যবহারিক তথ্যের জন্য একটি পঞ্জিকার প্রকাশিত তথ্যের পরামর্শ নেন। এটিতে মুসলমান, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য উৎসব, অনেক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বের জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ লিপিবদ্ধ করে এবং জ্যোতিষশাস্ত্র সম্পর্কিত তথ্যমূলক নিবন্ধ থাকে। বাঙালিদের মধ্যে বেণীমাধব শীলের ফুল পঞ্জিকাটি হলো অন্যতম জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত পঞ্জিকা। কি করে এত পরিচিত হল বেণীমাধব শীলের ফুল পঞ্জিকা?
বাঙালির আদি পঞ্জিকা ছিল ‘নবদ্বীপ পঞ্জিকা”। ঐতিহাসিকদের অনুমান তার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্মার্ত রঘুনন্দন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের (১৭১০-১৭৮২) আমলে রামরুদ্র বিদ্যানিধি নতুন করে গণনা আরম্ভ করেন। আগে তালপাতার পুঁথিতে এসব লেখা হত। প্রথম ছাপার অক্ষরে শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে ১৮৬৯ সালে। এই মুহূর্তে ৫-৬টা পঞ্জিকার মোট বিক্রি ৫০ লাখের ওপর। এক শ্রী মায়ের ‘কথামৃত’ ছাড়া আর কোনও বাংলা বই এর ধারে কাছে কোনওদিন পৌঁছয়নি।
এই বেণীমাধব শীলের পরিবার ছিল হাওড়ার মাকরসহ এলাকার বাসিন্দা। আজ থেকে ১৬০ বছর আগে হাওড়ার মাকড়দা থেকে মোহনচাঁদের প্রপিতামহ দ্বারিকনাথ শীল চাকরির খোঁজে এসেছিলেন কলকাতায়। সেদিন দ্বারিকনাথ আশ্রয় যেখানে পেয়েছিলেন, উত্তর কলকাতার সেই রাস্তার নাম আজ জয় মিত্র স্ট্রিট। চাকরি পান পোস্তায় পুরনো ট্যাঁকশালে। পরে ছেলে পূর্ণচন্দ্রও কাজ পান এই ট্যাঁকশালে। এই পূর্ণচন্দ্রই প্রথমবার বার করেন ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা। কিন্তু, উনি ছিলেন সরকারি চাকুরে। তাই পঞ্জিকার ব্যবসা চালাতেন মা মনমোহিনী দেবীর নামে।
পূর্ণচন্দ্রের ছেলে বেণীমাধব আর চাকরি নয়, আজীবন ব্যবসা করেন পঞ্জিকা নিয়ে। তার হাত ধরেই পঞ্জিকা হয়ে ওঠে সর্বজনবিদিত বেণীমাধব শীলের ফুল পঞ্জিকা। পরাধীন ভারতে কৃর্তী ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা তাহাদের ব্যবসা সামগ্রীতে নিজেদের নাম জুড়ে দিত। তারা বিশ্বাস করত এতে ব্যবসার মান উন্নত হয়। পাশাপাশি পন্য সামগ্রীর প্রতি ক্রেতাদের বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। কিন্তু, এক নামে অনেকেই পণ্য তৈরি হওয়াতে ক্রেতাদের মনে ভ্রান্তি দেখা যায়। কোনটা আসল আর কোনটা নকল। তাই তিনি প্রথম শুরু করলেন পঞ্জিকাতে নিজের ছবি লাগানো। ক্রেতাদের আর কোন ভ্রান্তির জায়গাই রইলো না।
আরও পড়ুন:NRC -এর নথি নিয়ে ভয়, ডাউনলোড করুন, ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত আপনার বিধানসভার ভোটার লিস্ট
এক সাহেব প্রফেসর ফিলিপ কটলারসন বেণীমাধরের ব্যবসার এই উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখে বলেছিলেন। এক শতাব্দী অতিক্রম করিয়াও কোন ব্যবসায়ী ইহাহেন সং সাহস দেখায়িতে পারিবে না’। বেণীমাধব প্রয়াত হন ১৯৮৯ সালে। এখন এই সব পঞ্জিকার মালিক তাঁর বড় ছেলে মোহনচাঁদ এবং ছোট অভিজিৎ। এঁদের মেজ ভাই শশাঙ্ক শীল ১৯৯৯ সালে মারা যান। উত্তর কলকাতার শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের প্রায় গা-লাগোয়া অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিটে পাঁচতলা বাড়িটি এদের অফিস- -কাম-বাড়ি। মোহনচাঁদের একটিই মেয়ে, পৌলোমী শীল ভট্টাচার্য। অভিজিতের দুই ছেলে অভিদেব ও অভিরণ। তিন ভাইবোন এখন বাবা-জ্যাঠার পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করছেন।
বেণীমাধব শীলের প্রায় সাত রকমের পঞ্জিকা আছে। সব ক’টির নামের শুরুতে রয়েছে বেণীমাধব শীল, তার পর ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা, সচিত্র পঞ্জিকা, ফুল পঞ্জিকা, হাফ পঞ্জিকা, পূর্ণাঙ্গ পঞ্জিকা, গার্হস্থ্য পল্লিকা ও পকেট পঞ্জিকা। শুধু বেণীমাধব শীলের যে বিভিন্ন সাইজের, পৃষ্ঠার নামের সাত-সাতটা সংস্করণ ফি বছর বেরোয়, তার সম্মিলিত বিক্রি বছরে ‘১২ লাখ’।
আরও পড়ুন:Group D Recruitment 2021: হাই কোর্টে গ্রুপ ডি স্টাফ নিয়োগ, এখি আবেদন করুন
বেণীমাধব শীলের পাঁড়ি আজও বাঙালির অন্যতম সঙ্গী। বাজারে যদিও আছে বেশ কয়েকটি পঞ্জিকা। তবে বাঙালির আশা ভরসা আজও বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকাই। তবে বছরভর পণ্ডিতমণ্ডলী পুনর্মার্জন ও সংশোধন করে চলেন তারা। প্রকাশিত হয় বেশ কয়েকটি সংস্করণ। ফাঁকি দিলে নিজেদেরই ক্ষতি। মুখ ঘুরিয়ে নেবেন ক্রেতারা। প্রতি বছর নভেম্বর মাসের শেষদিকেই পরের বছরের পঞ্জিকার কাজ শুরু হয়ে যায়। এভাবেই বছরের পর বছর চলে আসছে ‘বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা।