ফ্রান্স বনাম ইসলাম : সভ্যতার সংঘর্ষ ?

Breaking News সম্পাদকীয়

নজর বাংলা সম্পাদকীয় ডেস্ক: “ফরাসী স্কুলশিক্ষক স্যামুয়েল পাটি হজরত নবীর কার্টুন দেখিয়েছিলেন বলে তাঁকে মাথা কেটে খুন করেছে তাঁর ছাত্র ১৯ বছরের আব্দুল্লাখ আনজারোভ। আব্দুল্লাখ আনজারোভ চেচনিয়া থেকে আগত উদ্বাস্তু। নিজের স্কুল শিক্ষকের মাথা কেটে সে আদৌ অনুতপ্ত নয়। বরং একটি “বেশ করেছি” ভাব। ফরাসী পুলিশ আব্দুল্লখকে গুলি করে মেরেছে। তারপর থেকে ফ্রান্সে জনতা উত্তাল প্রতিবাদ শুরু করেছে। “Je suis Samuel” বা “আমিই স্যামুয়েল” প্ল্যাকার্ড ধরে হাঁটছেন উত্তাল জনতা। অবস্থা এমনই যে ফরাসী প্রধানমন্ত্রী এমানুয়েল ম্যাক্রো তাঁর মতামত জানাতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, “ইসলামের মধ্যে সমস্যা আছে। আমরা ফরাসী কার্টুন বা মতপ্রকাশের সংস্কৃতিকে ইসলামী সন্ত্রাসবাদীদের হাতে তুলে দিতে পারি না।” এই কথা শুনেই মধ্য প্রাচ্য সহ বিভিন্ন ইসলামিক দেশ থেকে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। যথারীতি সেই প্রতিবাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন “স্বনিযুক্ত খলিফা” তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রেসেপ তায়িপ এরদোয়ান। বিভিন্ন ইসলামী দেশ ফরাসী পণ্য বয়কটের দাবি জানিয়েছে। ”

উপরের যেটা লিখলাম, সেটি ঘটনা।.. যারা গত ১০ দিনের ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ করছেন, তাঁরা জানেন।

এমনই পরিস্থিতি যে অনেকের বাড়িতেই এই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এবং বেশ উত্তপ্ত যুক্তি – প্রতিযুক্তির লড়াই চলছে। আমি এই পোস্টে আমার মতামত দিচ্ছি কারণ আমি মনে করি যে এই বিষয় নিয়ে “রাজনৈতিকভাবে সঠিক” থাকার সময় পেরিয়ে এসেছে।

লড়াইটা এখন “আব্দুল্লাখ বনাম ম্যাক্রো” পেরিয়ে “ইসলাম বনাম ফ্রান্স”-এ এসে পৌঁছেছে। ..

এই অবস্থায় আমাদের মতো গান্ধীবাদী জাতীয়তাবাদী বামপন্থীর অবস্থান কি ? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ব্যাপারে আনজারোভ -এর দোষটি নিয়ে বেশিরভাগ লোক চুপ থাকবে (এবং বিজেপির বিচারধারা প্রসারে সুবিধা করবে) এবং ফ্রান্স কোথায় কি দোষ করেছে এই নিয়ে ফিরিস্তি দেবে। এবং যেন তেন প্রকারেণ মূল ইস্যু থেকে অন্যদিকে গিয়ে বিভ্রান্ত করবে।

আমি সেই দলে পড়ি না… আমি Organized Religion -এর ঘোষিত বিদ্রোহী। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তুল্যমূল্য বিচার করবো।

“মানবসম্পদ উন্নয়ন” নিয়ে যদি বিতর্ক হয়, তাহলে “চেচনিয়া” ফ্রান্সের ধারে কাছেও আসে না। .. ফ্রান্স সব দিক থেকে গোটা ইসলামিক দুনিয়ার থেকে উন্নত।

(১) ফ্রান্স চেচনিয়ার চেয়ে উন্নত না হলে আব্দুল্লাখ আনজারোভ ফ্রান্সে এসেছিলো কেন ? চেচনিয়ায় বসে বসে কোরান পড়েই ওঁর যাবতীয় “জীবনবিদ্যা”-র জ্ঞান (আব্দুল্লাখ ফ্রান্সে ঢুকেছিলো “জীবনবিদ্যা” পড়বে বলে) অর্জন করতে পারতো।
(২) ১৯৭৯ সালে যখন জুনায়মান-এর নেতৃত্বে ওয়াহাবী ছাত্রদের দ্বারা মক্কার প্রধান মসজিদ মসজিদ অল – হারাম দখলীকৃত হয়েছিল, তখন ফ্রান্সের কমান্ডো বাহিনীকে লেগেছিলো কেন মসজিদ দখলমুক্ত করতে ? “ইসলামের পবিত্র যোদ্ধা”-রা কোথায় ছিল ?

কাজেই “সভ্যতা হিসাবে চেচনিয়া ফ্রান্সের চেয়ে উন্নত” এমন গাঁজাখুরি গল্পে আমি বিশ্বাস করি না… জ্ঞান – বিজ্ঞান চর্চায় ইসলামিক দুনিয়াকে প্রচুর পরিশ্রম করতে লাগবে।

“আচ্ছা, বলো তো, আজ পর্যন্ত কজন মুসলিম বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ?”
উঃ মাত্র ৩ জন ! পাকিস্তানের আব্দুস সালাম, মিশরের আব্দুল জেবাইল, তুরস্কের আজিজ সংকার। সৌদি আরব বা ঐরকম “ধর্মীয় দেশ”-এর কেউ নেই। এই ৩ জনের কেউই কোনো “ইসলামিক দেশ”-এ বসে গবেষণা করেন নি। ব্রিটেন এবং আমেরিকাতে করেছেন। এঁদের মধ্যে আব্দুস সালাম “আহমেদিয়া”। এবং সেহেতু তিনি “মুসলিম” কিনা তাই নিয়েই পাকিস্তানে তর্ক বিতর্ক চলে। আসলে “ধর্ম” আর “বিজ্ঞান” একসঙ্গে চলে না। “ধর্ম”-কে প্রশ্ন করেছিলেন জিয়ারদিনো ব্রুনো, গ্যালিলিও, রেনে দেকার্তরা। .. আর সেই কারণেই “বিজ্ঞানচর্চা”-র সূচনা ইউরোপে। এর পেছনে “ব্ল্যাক ডেথ” বা বুওবনিক প্লেগের কারণটি একটি পোস্টে আলোচনা করবো। (আশ্চর্যের কথা হলো, জিয়ারদিনো ব্রুনোর চিন্তাধারার প্রেরণাপুরুষ ছিলেন এক মুসলিম। জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইবন রুশদ বা আভেরোস। সেই “স্বর্ণালী বিজ্ঞানচর্চা”-র সময় ইসলাম পেরিয়ে এখন কোন বিচারধারাকে আত্মস্থ করেছে সেটি ভাবার প্রয়োজন আছে বই কি !)

প্রশ্ন, এমন হাল ইসলামের কারা করলো ?
উঃ ১২৫৮ সালে হুলাগু খানের মঙ্গোল বাহিনীর হাতে বাগদাদের পতন হয়। তার পরের ৭০০ বছর ইসলামের নিয়ন্ত্রণ এমন শাসক , এমন School of Thought -এর হাতে যায়, যারা “ইসলামের ঐক্য”-এর নামে মানুষের “প্রশ্ন করার অধিকার” ছিনিয়ে নেয়। “প্রশ্ন করলেই কাফের”… “প্রশ্ন না করলেই” “তুই আমার ভাই”…

এই অবস্থায় স্বাধীন জ্ঞান – বিজ্ঞান চর্চা হবে কি করে ?

এমনিতে কিন্তু ইসলামিক স্থাপত্যের আমি বিরাট ভক্ত। তাজমহল, শিরাজের নাসির উল-মুলক মসজিদ, সামারখন্দের উলুঘ বেগের মাদ্রাসার সমকক্ষ কোনো স্থাপত্য পশ্চিমী দুনিয়া বানাতে পেরেছে বলে আমি মনে করি না… কিন্তু খ্রিস্টানরা চার্চের বাইরে গিয়েও বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেছিল মানুষের প্রয়োজনে। সেই “প্রয়োজন” ইসলামের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় নি।

ম্যাক্রো যে “সমস্যা”-টির কথা বলেছেন, তা এইখানে।

এখনো মুসলিমদের মধ্যে অনেকে জাকির নাইকের মতো আধা – মাথামোটা আধা -সেয়ানা লোককে বিরাট সম্মান দেয়। যেটি ওই “সমস্যা”-টির অংশ।

এই যে আব্দুল্লাখ আনজারোভ, ওকে কেউ একটা নিশ্চয়ই শিখিয়েছে যে, হজরত নবীর সম্পর্কে কিছু বললেই মাথা কাটতে হয়। এবং যে শিখিয়েছে সে একজন “মুসলিম”-ই। .. কোনো পুতিন, কোনো ম্যাক্রো আনজারভের ওই “শিক্ষা”-র জন্যে দায়ী নয়।

তার মানে যাঁরা “ইসলাম শান্তির ধর্ম” বলেন, তাঁদের এইটা তো মানতে হবে যে “ইসলাম” আসলে একটি নয়, যে কোনো Organized Religion -এর মতোই “ইসলামও অনেক গুলো “… আনজারভের “ইসলাম” আর মাউলানা আবুল কালাম আজাদের “ইসলাম” এক নয়। মওদুদীর “ইসলাম” আর এ পি কে আব্দুল কালামের “ইসলাম” এক নয়।

ঠিক এই জায়গায় এসেই আনজারোভ – মওদুদীর “ইসলাম” আজাদ – কালামের “ইসলাম”-কে বলে বসবে, “কাফের”… তারপরে লেলিয়ে দেবে একগাদা মূর্খের দলকে যারা এখনও বিশ্বাস করে যে, “ইন্তেকালের দিন সবাই আবার কবর থেকে জেগে যাবে”… (যাঁদের হাড়গোড় কবর থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে তাঁরাও ?)… ব্যাস, argument -ই খতম। .. “ইসলামিক বজরং দল” তখন আর argument শুনবে না… পুরো lynch mob … “মাথা কাটো”… “মাথা” নিয়ে সমস্যা সব “চাড্ডী”-দেরই। .. কারণ ওদের ওটি নেই। .. ঘাড়ের উপরে “ঝুনো নারকোল”…

ব্যাস, আমি এমানুয়েল ম্যাক্রোর “ইসলাম” সম্পর্কে বক্তব্য এই ভাবেই ব্যাখ্যা করবো। উনি মূলতঃ organized religion -কেই আক্রমণ করেছেন। হজরত নবী নিয়ে খারাপ কোনো কথা বলেন নি। ..

এবারে আমি “ফ্রান্স” নিয়ে কথা বলতে চাই। ..

ফ্রান্স আসলে “নৈরাজ্যবাদী”-দের দেশ। .. Authority নিয়ে ওখানে চিরকালের সমস্যা। এবং সেই সংস্কৃতির সঙ্গে Subvertive Satire -এর ঐতিহ্য বেশ পুরানো। “Le Grelot ” বলে একটি Caricature -এর সংবাদপত্র প্রকাশ করা হতো ঊনবিংশ শতকে যা খুব জনপ্রিয় ছিল। রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক , সামাজিক কোনো বিষয়েই ফরাসীরা প্রশ্ন করতে ছাড়ে না… “ধর্মীয়” ব্যাপার তো বাদই দাও। .. হেন কোনো ফরাসী বিখ্যাত ব্যক্তি নেই যিনি কোনো না কোনো সময়ে ফরাসী ব্যঙ্গের শিকার হন নি। .. এই “ব্যঙ্গ” সাংস্কৃতিক জগৎ ছেড়ে খেলাধূলার জগতেও বিদ্যমান। ফরাসী ওপেন টেনিসে দর্শকদের একটি কাজই হলো, অপছন্দের খেলোয়াড়দের টার্গেট করে “boo” করা। ..

কিন্তু প্রশ্ন হলো, “হজরত নবী কি করে সেই Satire -এর subject হতে পারেন ? ওঁর সম্পর্কে তো কেউই খুব একটা কিছু জানেন না ”

আসলে এই জায়গাতেই ফ্রান্সের “দক্ষিণপন্থী”-দের ভূমিকা আছে। গসিনী – উদেরজোর “এস্টেরিক্স – ওবেলিক্স” আমরা কে পড়ি নি ? ঐখানেও কিন্তু “নৈরাজ্যবাদ”-এর সঙ্গে সঙ্গে anti -Authoritarianism (রোমান সৈন্যদের ওড়ানো), দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদ পাওয়া যাবে। এই “দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদ” খুব চতুরতার সঙ্গে নিজেদের victim দেখিয়ে হজরত নবীকে আক্রমণ করে “উদ্বাস্তু অনুপ্রবেশ”-এর বিরোধিতা করছে।

আব্দুল্লাখদের প্রতিক্রিয়াটি অত্যন্ত মোটা দাগের। কিন্তু ফরাসীদের সূক্ষ্ম দাগের provocation -টিকে উপেক্ষা করা ভুল হবে। মোষের সামনে লাল পতাকা নাড়িয়েছে , মোষ গুঁতিয়ে দিয়েছে। ..

এখন তুমি “লাল পতাকা নাড়ানোর” পক্ষে ? না মোষের পক্ষে ?

উঃ যেকোনো গান্ধীবাদীর মতোই আমি dialogue -এর পক্ষে।.. আলোচনা চলুক নিজেদের মধ্যে।.. যাঁরা ফরাসী দেশের সংস্কৃতি-জীবনবোধ মানেন না, তাঁদের ফ্রান্সে থাকার কোনো অধিকার নেই। ফ্রান্স “চেচেন সংস্কৃতি” প্রতিষ্ঠা করার জায়গা নয়। একই সঙ্গে ফরাসীদের অন্যদের ভাবাবেগে সুড়সুড়ি দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

কোনো ইসলামিক দেশ তো ফ্রান্সের নায়কদের হ্যাটা করার চেষ্টা করে নি। তাহলে ফরাসীরা কেন নিজেরা এমন অসাংস্কৃতিক ছ্যাঁচড়ামিতে অংশ নিচ্ছেন ? সাম্রাজ্যবাদের সময়ে বা এখনও ফ্রান্সের আর্থনৈতিক কলেবর বৃদ্ধিতে মুসলিম দেশ গুলির বিরাট ভূমিকা আছে। ..

✍️কলমে- সায়ক ঘোষ চৌধুরী (রাজনৈতিক বিশ্লেষক)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *