নজর বাংলা ডিজিটাল ডেস্ক: ভারতে মুসলিমদের অবস্থান নিয়ে সাউথ এশিয়ার মূলত ভারত এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ফরাসি রাজনীতি বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার জাফরলােট সম্প্রতি একটি আলােচনা সভায় বক্তৃতা দেন। সেই বক্তৃতার উপর নির্ভর করে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্র সিয়াসত ডট কম একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। ওই প্রতিবেদনের সাম্প্রতিকতম প্রকাশের তথ্য অনুযায়ী জাফর বলেছেন ভারতে আইন সভায় মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এবং সেই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ভারতের কারাগারে।
ওই প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জাফরলােট জানিয়েছেন, ১৯৮০ দশক থেকে লোকসভায় মুসলিম প্রতিনিধিত্ব ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। তথ্য থেকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেছিলেন, “১৯৮০ সালে যখন মুসলমানরা সমাজের ১১% ছিল, ৪৯ জন সংসদীয় সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন যা লোকসভার মােট আসনের ৯% ছিল। ২০১৪ সালে এই পরিসংখ্যান সর্বনিম্ন হয়েছে যখন, বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জেতে এবং সরকার গঠন করে। ২১ জন মুসলিম সংসদীয় সদস্য অর্থাৎ মােট লোকসভার ৪% এর নিচে নির্বাচিত হয়েছিলেন, কারণ, বিজেপির একজন সদস্য ও মুসলিম নন। তবে, ২০১৯ সালে, মুসলিম সাংসদরা ২৫ টি আসন যেতে এবং আসন সংখ্যা ২১ থেকে ২৫-এ, প্রান্তিকহারে বৃদ্ধি পায় যদিও পরিসংখ্যান মােট লোকসভা আসনের ৫% এর নীচে থেকে যায়। জাফরলােট আরাে বলেছেন, লোকসভা স্তরে যা সত্য তা রাজ্য সমাবেশ গুলোর ক্ষেত্রে সমান সত্য।
গুজরাটে ৯.১% মুসলিম জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ১.৬% মুসলিম বিধায়ক রয়েছেন। ১৯৮০-র দশকের গােড়ার দিকে যার পরিমাণ ছিল শতকরা হারে ৬%। কর্ণাটকের ১২.২% মুসলিম জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ৩.১% মুসলিম বিধায়ক; ১৯৭০ এর দশকের শেষদিকে যার পরিমাণ ছিল শতকরা হারে ৭% এর বেশি।
মধ্যপ্রদেশে, ৬.৪% মুসলিম জনসংখ্যার মধ্যে বিধানসভায় মাত্র ০.৪% মুসলমান রয়েছেন। ক্রিস্টোফ জাফরলােট বলেছেন, বাস্তবে মাত্র একজন বিধায়কই মুসলিম। ১৯৭০-এর দশকের গােড়ার দিকে যার পরিমাণ ছিল শতকরা হারে ২.৭%।
ফরাসি রাজনৈতিক বিজ্ঞানী আরাে বলেন, মহারাষ্ট্রে যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা ১০% এর বেশি, সেখানে বিধায়কদের মধ্যে মাত্র ৩.১% মুসলমান। ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি সময়ে এই পরিসংখ্যান ছিল শতকরা হারে ৯%। তিনি আরাে বলেন, উড়িষ্যার জনসংখ্যার মাত্র ২% মুসলিম এবং এই সম্প্রদায়ের বিধায়করা মাত্র ০.৭%। ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি এই পরিসংখ্যান ছিল ২.৭%। রাজস্থানে কেবল ১% বিধায়ক মুসলিম, যেখানে ১৯৮০-র দশকের গােড়ার দিকে এর পরিসংখ্যান ছিল শতকরা হারে ৫%।
এ প্রসঙ্গে উত্তরপ্রদেশের পরিসংখ্যানকে উল্লেখযোগ্য বলে মন্তব্য করে জাফরলােট বলেন, উত্তরপ্রদেশের পরিসংখ্যান সবচেয়ে আকর্ষণীয়। ২০১৭ সালের আগে অর্থাৎ বিজেপির জয় লাভের আগে পর্যন্ত ১৮.৫% মুসলিম জনসংখ্যার মধ্যে, ১৬.৯% বিধায়ক মুসলমান ছিলেন। ২০১৭ সালে মুসলিম বিধায়কদের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে মাত্র ৫.৭%।
এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কথা উল্লেখ করে জাফরলােট বলেছেন, এ ব্যাপারে একমাত্র ব্যাতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ। ২৫.২% মুসলিম জনসংখ্যার মধ্যে, মুসলিম বিধায়কদের সংখ্যা ২০%। ১৯৮৫ সালে যা ছিল মাত্র ২.৯%। রাজ্য বিধানসভা গুলিতে মুসলিম বিধায়কদের উপস্থিতির এহেন পরিসংখ্যান উল্লেখ করে ওই ফরাসি রাজনৈতিক বিজ্ঞানী বলেছেন, উপরের তথ্য প্রমাণ করে যে বিজেপির উত্থানের সবচেয়ে স্পষ্ট প্রভাব হচ্ছে লোকসভা এবং রাজ্য সমাবেশগুলিতে মুসলিম প্রতিনিধিত্ব হ্রাস।
২০১৯ সালে সিএসডিএস-এর রিপাের্টে প্রকাশিত একটি তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিজেপির শাসনভারে আসার অপর একটি প্রভাব হিসেবে জাফরলােট বলেছেন, মুসলিমরা ভারতে পুলিশকে পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে দেখে।
অন্য যেকোনাে কোনও দলের চেয়ে মুসলিমরা পুলিশকে বেশি ভয় পায়; দলিতরা তার পরের স্থানে।মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে “পুলিশ প্রায়ই মুসলমানদের জোর করে সন্ত্রাসবাদের অভিযােগে জড়িত করে। এমন কিছু মামলা রয়েছে যেখানে বছরের পর বছর ধরে কারাগারে বন্দি হয়ে রয়েছেন যুবকরা। জাফরলােট ২০১৫ সালে প্রকাশিত এনসিআরবি সর্বশেষ প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে কারাগারে বন্দিদের মধ্যে ২১% মুসলমান যেখানে মােট জনসংখ্যায় তাদের অংশীদারিত্বের পরিমাণ ১৪.৫% বেশি।
তিনি এ বিষয়ে আমেরিকার কারাগারে বন্দি কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে তুলনা করে বলেছেন, এই অতিরিক্ত প্রতিনিধিত্ব আমেরিকান কারাগারে থাকা কৃষ্ণাঙ্গদের অতিরিক্ত উপস্থাপনের কিছুটা আনুপাতিক।
এ বিষয়ে তিনি আরাে বলেন, যাদের শাস্তি হয় এবং যারা বিচারাধীন থাকেন না, তাদের দিকে নজর দিলে দেখা যায়,এই হার ২১% থেকে ১৫.৮% এ নেমে আসে, যা ভারতে তাদের জনসংখ্যার সরাসরি অনুপাত। এর অর্থ হ’ল, প্রকৃতপক্ষে অনেক মুসলমান কারাগারে গেছেন কারণ পুলিশ তাদের ভুলভাবে কোন অপরাধে জড়িয়ে দিয়েছে। আদালত যখন তাদের মামলায় নজর করেন তখন তারা মুক্তি পায়।
জাফরলােট বলেন, “এটি অবশ্যই সাম্প্রতিক আরেকটি বিকাশ যা ভারতীয় রাজনীতিতে নতুনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি তিনি মনে করেন যে, এটা ভারতীয় পুলিশে মুসলমানদের প্রতি অবজ্ঞার প্রতিফলন। এ প্রসঙ্গে তিনি আরাে বলেন, আসল বিষয় হলাে ১৯৪৭ সাল থেকে মুসলমানরা কংগ্রেসের দ্বারা আপ্যায়িত হননি। তিনি বলেন, ১৯৯০এর দশক থেকে ২০০০ এর দশক পর্যন্ত এবং পরবর্তী বছরগুলিতে আরও বেশি মুসলিম অবস্থার অবনতি ঘটেছে এবং এটি অবশ্যই বিজেপির উত্থানের সঙ্গে সমান্তরাল।
ক্রিস্টোফ জাফরলােট মনে করেন যে সিএএ-এনআরসি ভারতীয় মুসলমানদের জন্য মেয়াদে এবং মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে শিক্ষার পক্ষে একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। তিনি বলেন, “এসসি, এসটি, ওবিসিদের সাথে মুসলমানরা সামাজিক বিভাগগুলির মধ্যে রয়েছে, যেখানে আপনি ৫ বছরের কম বয়সের বাচ্চাদের জন্ম শংসাপত্র খুঁজে পাবেন না। যার ফলে, নাগরিকত্ব প্রমাণ করা খুব কঠিন হবে। প্রাথমিকভাবে আসাম এবং পরে অন্যত্রও এটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
ক্রিস্টোফ আরাে বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়,ইউএনও ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, প্রথমবারের মতাে, ভারতীয় নাগরিকত্ব অ্যাক্সেসের জন্য বিধি পরিবর্তনের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। এটা প্রভাব ফেলবে কি না তা এখনও দেখা বাকি।
তিনি আরাে বলেছেন, মধ্য-মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী শিক্ষা ভারতীয় মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যা উদ্বেগজনক তা হ’ল ভারতে শিক্ষিত ও অভিজাত মুসলমানরা খুব দ্রুত সঙ্কুচিত হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, “প্রত্যেক সম্প্রদায়ের অভিজাত, তরুণ শিক্ষিত অভিজাতদের প্রয়োজন। তারা ইতিহাসের গতিপথ, সম্প্রদায়ের গতিপথ কিছুটা বদলে দিতে পারে কারণ এই বিষয়গুলির যত্ন নেওয়ার জন্য তারা অন্যদের চেয়ে আরও ভাল জায়গা করে নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি পরিসংখ্যান এর উল্লেখ করে ক্রিস্টোফ বলেছেন, ২০১৭-১৮ সালে মাত্র ১৪% মুসলিম যুবক স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন, সেখানে ১৮% দলিত,২৫% হিন্দু ওবিসি এবং ৩৭%হিন্দু উচ্চবর্ণের যুবকরা স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
Created- TDN Bangla